প্রশ্ন
বিশ্ব মা দিবসকে কুরআন-সুন্নাহ কিভাবে দেখে?
উত্তর
بسم الله الرحمٰن الرحيم. حامدا و مصليا و مسلما
ইসলামে মায়ের হক আদায় করা বা মাকে সম্মান করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন নেই। বরং প্রতি মুহূর্তে মায়ের হক আদায়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। তারপরও ১৯১৪ সালে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উডরো উইলসনের প্রচেষ্টায় আমেরিকায় মা দিবস উদযাপন করা হয়। পরবর্তীতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তা ছড়িয়ে পড়ে।
বিভিন্ন দেশের অধিকাংশ ইসলামি স্কলারদের মতে এই দিনটি পালনে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো বাধা নেই। এ ব্যাপারে জর্ডানের ফাতওয়া বোর্ডের বক্তব্য হল, আল্লাহ তাআলা কুরআনে মাকে শ্রদ্ধা করার কথা বলেছেন। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,
أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ
‘সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই।’ [সূরা লুকমান, আয়াত: ১৪]
আরেক আয়াতে এসেছে,
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
‘আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে।’ [সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ২৩]
মা দিবস পালন করা যাবে- এ মর্মে তারা একটি হাদিস দিয়ে দলিল দিয়ে থাকেন। হাদিস শরিফে এসেছে ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত,
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم لَمَّا قَدِمَ الْمَدِيْنَةَ وَجَدَهُمْ يَصُومُوْنَ يَوْمًا يَعْنِيْ عَاشُوْرَاءَ فَقَالُوْا هَذَا يَوْمٌ عَظِيْمٌ وَهُوَ يَوْمٌ نَجَّى اللهُ فِيْهِ مُوْسَى وَأَغْرَقَ آلَ فِرْعَوْنَ فَصَامَ مُوْسَى شُكْرًا لِلهِ فَقَالَ أَنَا أَوْلَى بِمُوْسَى مِنْهُمْ فَصَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ
‘রাসূল (সা.) যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন তিনি মদিনাবাসীকে এমনভাবে পেলেন যে, তারা একদিন সওম পালন করে অর্থাৎ সে দিনটি হল আশুরার দিন। তারা বলল, এটি একটি মহান দিবস। এ এমন দিন যে দিনে আল্লাহ মূসা (আ.)-কে নাজাত দিয়েছেন এবং ফিরআউনের সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর মূসা (আ.) শুকরিয়া হিসেবে এদিন সওম পালন করেছেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, তাদের তুলনায় আমি হলাম মূসা (আ.)-এর অধিক নিকটবর্তী। কাজেই তিনি নিজেও এদিন সওম পালন করেছেন এবং এদিন সওম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩৯৭]
এ হাদিস থেকে দিবস পালনের বৈধতা প্রমাণিত হয়। তবে একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে এসেছে,
أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ سَلَكُوْا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوْهُ قُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى قَالَ فَمَنْ
‘রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের পন্থা পুরোপুরি অনুসরণ করবে, প্রতি বিঘতে বিঘতে এবং প্রতি গজে গজে। এমনকি তারা যদি গুই সাপের গর্তেও ঢুকে তবে তোমরাও তাতে ঢুকবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি ইয়াহূদী ও নাসারার কথা বলছেন? রাসূল (সা.) বললেন, তবে আর কার কথা?’ [সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৪৫৬]
তারা বলে থাকেন, এই ধরনের হাদিস মা দিবস পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হবে না। কারণ, রাসূল (সা.)-এর নিষেধাজ্ঞা হল তাদের দ্বীনী শিআর অনুসরণের ক্ষেত্রে এবং এমন জিনিসের অনুসরণের ক্ষেত্রে যা ইসলাম বিরোধী। যেহেতু মা দিবসে ইসলাম বিরোধী কোনো বিষয় পাওয়া যায় না এবং এটি বিধর্মীদের শিআরও নয় তাই এটি পালন করা জায়েয।
মিশরের ফাতওয়া বোর্ডও একই কথা বলেছেন যে, এটি যেহেতু ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং ইসলামের একটি বিধানকেই প্রমোট করা হচ্ছে, তাই এটি জায়েয।
বাইতুল মাকদিসের ফাতওয়া বোর্ড বলেছেন যে, এই দিবস পালনে কোনো অসুবিধা নেই। শাইখ কারযাবীও এই মত পোষণ করেছেন। তবে এক্ষেত্রে তারা সকলেই তিনটি শর্তারোপ করেছেন।
১. এটিকে শরিয়ত নির্ধারিত কোনো উৎসব মনে করা যাবে না। কারণ ইসলামি শরিয়তে তিনটি দিবস উদযাপনের কথা বলা হয়েছে। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ও জুমার দিন। এছাড়া অন্য কোনো দিনকে শরিয়তের উৎসবের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
২. মাকে ভালোবাসার জন্য এই একটি দিনকেই নির্দিষ্ট করা যাবে না।
৩. এই দিবস পালনকে কেন্দ্র করে শরিয়ত বিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত হওয়া যাবে না।
অপরদিকে সাউদী ফাতওয়া বোর্ডের সিন্ধান্ত হল, এই দিনটি পালন করা যাবে না। তাদের দলিল হল,
مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
‘যে ব্যক্তি এমন কোন কর্ম করলো যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৩৮৫]
শাইখ উসাইমীন, শাইখ বিন বায সকলেই একই কথা বলেছেন যে, রাসূল (সা.) বা সাহাবায়ে কেরাম থেকে এমন দিন পালনের কথা বর্ণিত হয়নি, তাই এ দিবস পালন করা যাবে না।
দেখুন, এই দিনটি পালনে কোনো কল্যাণ বয়ে আনে- বিষয়টি কিন্তু এমনও নয়। বরং ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলো শুধু এই একদিনেই পিতা-মাতার খবর নিয়ে থাকে। সারা বছর আর কোনো খবর নেয় না। এখন তো অনলাইনের যুগ হওয়ার কারণে একটি মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েই নিজের দায়িত্ব পূর্ণ করে নেয়। এটি ইসলাম সমর্থন করে না। বরং ইসলামে প্রতিদিনই মা দিবস। প্রতি মুহূর্তেই মায়ের খোঁজ খবর নিতে হবে। তার সেবা-শুশ্রূষা করতে হবে। এটিই হল ইসলামের প্রকৃত বিধান। এ সম্পর্কে বহু আয়াত ও হাদিস পাওয়া যাবে। কাজেই আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, এ দিনকে নিয়ে মাতামাতি করার সুযোগ নেই। এটি মনে করার সুযোগ নেই যে, এটিই মায়ের জন্য একমাত্র দিন। অন্যদিন মায়ের কোনো খোঁজ খবর নেওয়া যাবে না। এমনটি যেন না হয়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বুঝার তাওফিক দান করুন।
আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
و الله تعالى أعلم بالصواب
وصلى الله تعالى على رسوله وعلى آله وسلم
উত্তর দিচ্ছেন:
ড. মুফতি মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান মাদানী
সূত্র: https://www.drkhalilurrahman.com/7908/article-details.html