প্রশ্ন
আল্লাহর অশেষ দয়ায় আমি একাধিকবার বাইতুল্লাহর হজ্ব করতে পেরেছি এবং সবসময় চেষ্টা করি, প্রতি বছর না হলেও অন্তত তিন বছরে যেন একবার যাওয়া হয়। সে হিসাবে আমি আগামী বছরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কিন্তু দেশের কিছু অঞ্চলে বন্যা হওয়ায় শত শত পরিবার বিপদের সম্মুখীন হয়। সেখানে আমার কিছু আত্মীয়-স্বজনও আছে। এ অবস্থায় আমাদের ইমাম সাহেব আমাকে পরামর্শ দেন এবারের হজ্বের জন্য জমা করা অর্থগুলো মানবতার সেবায় দান করে দিতে। তিনি বলেন, নফল হজ্বের চেয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোই বেশি ফযীলতের। তার কথামতো সে অর্থ আমি ঐ খাতে দান করে দেই। এখন চিন্তা হচ্ছে, আসলে কোনটা উত্তম ছিল, দান করে দেয়া, নাকি হজ্বে যাওয়া। এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানিয়ে আমাকে আশ্বস্ত করবেন।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
حامدا و مصليا و مسلما
প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে নফল হজ্বের জন্য সংগৃহীত অর্থ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সেবায় দান করে দেওয়া সওয়াবের কাজই হয়েছে। এটা দূষণীয় কিছু হয়নি। কারণ সেটি ছিল বিশেষ সঙ্কটময় মুহূর্ত। আর স্বাভাবিক অবস্থায় একজন ব্যক্তি নফল হজ্ব করবে, নাকি সে টাকা দান খায়রাতে ব্যয় করা তার জন্য উত্তম হবে- এটি আপেক্ষিক বিষয়। যাদেরকে আল্লাহ তাআলা অনেক ধন-সম্পদের নিআমত দান করেছেন তারা দুটি কাজ সমন্বয় করেই করতে পারেন। তিনি ফরয-ওয়াজিব সদকা আদায়ের পাশাপাশি নফল দান-খায়রাতও করবেন এবং মাঝে মাঝে নফল হজ্ব-উমরায়ও যাবেন। দুটি নেক কাজের মাঝে সাংঘর্ষিক ভাব তৈরি করার দরকার নেই। কারণ এ কাজগুলো একটি করলে আরেকটি করা যাবে না এমন তো নয়। মনে রাখা দরকার, নফল হজ্বও অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ আমল। কেননা হজ্বের মধ্যে আল্লাহর রাস্তায় অর্থ ব্যয় এবং সফরের কষ্ট স্বীকার করে আল্লাহর হুকুম পালনের মধ্য দিয়ে নিজের ঈমানী শক্তিবৃদ্ধি- দুটোই রয়েছে। তাছাড়া হজ্বে রয়েছে আত্মিক ও নৈতিক বহুবিধ উপকার। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ اَذِّنْ فِی النَّاسِ بِالْحَجِّ یَاْتُوْكَ رِجَالًا وَّ عَلٰی كُلِّ ضَامِرٍ یَّاْتِیْنَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِیْقٍ، لِّیَشْهَدُوْا مَنَافِعَ لَهُمْ َ…
এবং মানুষের মধ্যে হজ্বের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং প্রতিটি শীর্ণকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে। যেগুলো আসবে বহু দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। যেন তারা পরিদর্শন করে এমন সব বিষয় ও স্থান, যাতে রয়েছে তাদের প্রভূত কল্যাণ…। (সূরা হজ্ব, আয়াত: ২৭, ২৮)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
سُئِلَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَيّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: إِيمَانٌ بِاللهِ وَرَسُولِهِ. قِيلَ: ثُمّ مَاذَا؟ قَالَ: جِهَادٌ فِي سَبِيلِ اللهِ. قِيلَ: ثُمّ مَاذَا؟ قَالَ: حَجّ مَبْرُورٌ.
নবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হল, কোন আমল সবচে’ উত্তম? বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হল, তারপর কোনটি? বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। বলা হল, তারপর? বললেন, হজ্জে মাবরূর। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৫১৯)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজী (সা.) বলেছেন-
العُمْرَةُ إِلَى العُمْرَةِ كَفّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا، وَالحَجّ المَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلّا الجَنّةُ.
এক উমরা থেকে আরেক উমরা মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহসমূহ মোচন করে দেয়। আর মাবরূর হজ্বের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৭৭৩)
سُئِلَ طَاوُسٌ الْحَجّ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ أَفْضَلُ أَمِ الصّدَقَةُ؟ فَقَالَ: أَيْنَ الْحِلّ وَالرّحِيلُ، وَالسّهَر وَالنّصَبُ، وَالطّوَافُ بِالْبَيْتِ وَالصّلَاةُ عِنْدَهُ، وَالْوُقُوفُ بِعَرَفَةَ وَجَمْعِ وَرَمْيِ الْجِمَارِ؟ كَأَنّهُ يَقُولُ: الْحَجّ .
তাবেয়ী তাউস (রাহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হল, নফল হজ্ব উত্তম, নাকি দান-সদকা? তিনি উত্তর দিলেন, সফরের কষ্ট, নির্ঘুম রাত্রি যাপনের কষ্ট, দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট। বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, বাইতুল্লাহর সামনে নামায, আরাফা ও মুযদালিফায় অবস্থান এবং কংকর নিক্ষেপ (এসব তো সদাকায় আর পাওয়া যায় না)। অর্থাৎ তিনি যেন বলতে চাচ্ছেন, হজ্বই উত্তম। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস: ৮৮২২)
মুহাম্মাদ ইবনে আব্বাদ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
النّفَقَةُ فِي الْحَجِّ كَالنّفَقَةِ فِي سَبِيلِ اللهِ، الدِّرْهَمُ بِسَبْعِ مِئَةٍ.
হজ্বের জন্য অর্থ ব্যয় করা আল্লাহর রাস্তায় খরচের সমতুল্য। এতে এক দিরহামের বিনিময়ে সাতশ দিরহামের সওয়াব অর্জিত হয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস: ১২৮০৩)
এসব হাদিস-আসার থেকে নফল হজ্বের অধিক গুরুত্বের দিকটিই প্রমাণিত হয়। অবশ্য কখনো কখনো নফল হজ্বের চেয়ে দান-সদকার বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন, মুসান্নাফে আবদুর রাযযাকে আছে-
عَنِ الثّوْرِيِّ، وَسَأَلَهُ رَجُلٌ فَقَالَ: الْحَجّ أَفْضَلُ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ أَمِ الصَّدَقَةُ؟ فَقَالَ: أَخْبَرَنِي أَبُو مِسْكِينٍ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ أَنّهُ قَالَ: إِذَا حَجّ حِجَجًا، فَالصّدَقَةُ. وَكَانَ الْحَسَنُ يَقُولُ: إِذَا حَجّ حَجّةً.
অর্থাৎ সুফয়ান ছাওরী (রাহ.) থেকে বর্ণিত, তাকে এক লোক জিজ্ঞেস করল, নফল হজ্ব উত্তম নাকি দান-সদকা? তিনি তখন ইবরাহীম নাখায়ীর সূত্রে বললেন, যদি একাধিক হজ্ব করে থাকে তাহলে সদাকা। আর হাসান (রাহ.) বলতেন, যদি একবার হজ্ব করে থাকে (তাহলেও সদাকাই উত্তম)। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস: ৮৮২৩)
এর ব্যাখ্যায় ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, এটা সাধারণ দান-সদকার বেলায় নয়; বরং বিশেষ ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ যদি আপনার এমন কোনো দুস্থ অভাবী আত্মীয় থাকে, যাকে দেখার কেউ নেই, বা দেশে যদি কোনো জাতীয় দুর্যোগ অথবা বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয়, কিংবা সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর কোনো চাহিদা সামনে এসে দাঁড়ায়, যেখানে একার চেষ্টায় বা মুষ্টিমেয় লোকের অর্থায়ন যথেষ্ট নয়; বরং বহু মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে, তাহলে এসব ক্ষেত্রে সংগৃহীত অর্থ দান করে দেয়াকে তারা নফল হজ্বের চেয়ে উত্তম গণ্য করেছেন। কিন্তু যে ব্যক্তি নফল হজ্বে গিয়েও অতিরিক্ত দান-খয়রাত করার সামর্থ্য রাখে সে উভয়টিই করবে।
-রদ্দুল মুহতার ২/২৬১; মুখতাছারু ইখতিলাফিল উলামা ২/২৪২; গুনয়াতুন নাসিক, পৃ. ১৯৬; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাল মারাকী পৃ. ৪০৩
আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
و الله تعالى أعلم بالصواب
وصلى الله تعالى على رسوله وعلى آله وسلم
উত্তর দিচ্ছেন:
ড. মুফতি মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান মাদানী
সূত্র:https://www.drkhalilurrahman.com/?p=28670&preview=true